ডেস্ক রিপোর্ট ॥ ফেরদৌসি জামান নামের এক গ্রাহকের সঞ্চয়ী হিসাব থেকে ৫ কোটি ১৬ লাখ ১০ হাজার টাকা আত্মসাতের সঙ্গে ১৫ ব্যাংক কর্মকর্তা জড়িত। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও ব্যাংক প্রতিশ্রুতির পর প্রথমে গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করেনি। এতে গ্রাহক অভিযোগ করলে তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ পরিস্থিতিতে গ্রাহকের অর্থ ফেরতের নির্দেশ দেওয়া হলে ব্যাংক টাকা দিতে বাধ্য হয়। বুধবার প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এতে ব্যাংকিং খাতে গ্রাহকদের অভিযোগ ও নিষ্পত্তির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, ২০১৬ সালে ৬ কোটি ৬০ লাখ ৭০ হাজার ২৯৫ টাকা জমা দিয়ে একটি বেসরকারি ব্যাংকে সঞ্চয়ী হিসাব খুলেন গ্রাহক ফেরদৌসি জামান। পরে বিভিন্ন সময়ে তিনি চেক দিয়ে টাকা উত্তোলন করেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর গ্রাহকের নির্দেশে বাহক টাকা উত্তোলনের জন্য ব্যাংকে গেলে হিসাবটিতে পর্যাপ্ত টাকা নেই বলে মৌখিকভাবে জানিয়ে চেকটি ডিজঅনার করে ব্যাংক কর্মকর্তা। অথচ এর আগে ব্যাংক থেকে সংগৃহীত হিসাব বিবরণী অনুযায়ী ওই হিসাবে ৫ কোটি ৫৬ লাখ ১৫ হাজার ১৩৯ টাকা রয়েছে বলে জানেন গ্রাহক। চেক ডিজঅনারের সংবাদ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই গ্রাহক স্বামীসহ ওই শাখায় যান। শাখা ব্যবস্থাপক সব কাগজপত্র যাচাই করে টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে তার হিসাব থেকে তুলে নেওয়া হতে পারে বলে জানান। একইসঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব টাকা ফেরত দেওয়ার আশ্বাস প্রদান করেন। পরে শাখা ব্যবস্থাপক কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকে (এমডি) জানান ভুক্তভোগী ওই গ্রাহক। এমডির নির্দেশে ঘটনার তদন্ত করা হয়। পরে তিনিও জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা খোয়া যাওয়ার কথা স্বীকার করে তা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। একইসঙ্গে গ্রাহককে ঘটনাটি প্রকাশ না করার অনুরোধ করেন। এরপর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও ব্যাংক গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়নি। কোনো উপায় না দেখে গ্রাহক বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করেন। এর ভিত্তিতে জবাব চাইলে ব্যাংক প্রথমেই অভিযোগটি ভিত্তিহীন বলে কেন্দীয় ব্যাংককে জানায়। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ঘটনার বিষয়ে তদন্ত শুরু করে। এ প্রক্রিয়ায় ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদন, গ্রাহকের হিসাব বিবরণী, গ্রাহকের হিসাব খোলার ফরমসহ আনুষঙ্গিক কাগজপত্র নিয়ে পর্যালোচনায় করে। এতে দেখা যায় যে, ব্যাংকের নিজস্ব তদন্তে ওই জালিয়াতির ঘটনায় তৎকালীন অ্যাসিস্টেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সেন্টার ম্যানেজার সরওয়ারকে দায়ী করা হয়েছে। হিসাবটি খোলা থেকে ব্যাংকিং লেনদেনের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বভার তৎকালীন এভিপির ওপর অর্পিত ছিল এবং বিভিন্ন পর্যায়ে ওই হিসাবটিতে তিনি নিজে জালিয়াতি করে টাকা উত্তোলন করেন। এমনকি গ্রাহকের অজ্ঞাতে হিসাবে প্রদত্ত মোবাইল নম্বরটিও ব্যাংকের আইটি বিভাগের সহায়তায় পরিবর্তন করা হয়। গ্রাহকের ভুয়া সম্মতি দেখিয়ে হিসাব খোলার পর থেকে চারটি চেকবই ইস্যু করা হয়েছে। অথচ গ্রাহক একটি ছাড়া অন্য কোনো চেক বই নেননি বলে জানান। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল ব্যাংকের ভেতরের সিসি টিভি ফুটেজের রেকর্ড পর্যালোচনা করে। এতে দেখা যায়, বর্ণিত চেকবই ব্যবহার করে সব টাকা তৎকালীন এভিপি সরওয়ার উত্তোলন করেছেন এবং ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবরের পর থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন। ব্যাংকের নিজস্ব তদন্তে ওই জালিয়াতির ঘটনায় বিভিন্ন পর্যায়ের ১৫ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণসহ দুদকে মামলা দায়ের করার পরও ব্যাংক গ্রাহককে টাকা ফেরত দেয়নি। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিস্ময় প্রকাশ করে। আমানতের খেয়ানতের ঘটনায় ব্যাংক কর্মকর্তারে বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, চেক জাল করে গ্রাহকের হিসাব থেকে অর্থ জালিয়াতি বা প্রতারণার ঘটনায় ব্যাংকের নিজস্ব তদন্তে নিজেদের কর্মকর্তা বা কর্মচারী জড়িত বলে প্রমাণিত হলে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রাহকের দাবি করা টাকা ফেরৎ দিতে হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংককে গ্রাহকের হিসাব থেকে আত্মসাৎ করা ৫ কোটি ১৬ লাখ ১০ হাজার টাকা ফেরত দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানোর নির্দেশ দেয়। এর পর ব্যাংক গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হয়। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকিং খাতের নৈতিক অবক্ষয়ের একটি ঘটনা এটি। মানুষ তার শ্রমের অর্জন সঞ্চয়টুকু জমা রাখেন ব্যাংকে। ব্যাংকারদের ওপর অগাধ বিশ্বাস থেকে। সেই বিশ্বাসের খেয়ানত করা বড় অপরাধ। এগুলো যারা করে তাদের দ্রুত শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তাহলে এ ধরনের অপরাধ কমে যাবে। গ্রাহকদের আস্থা বাড়বে।
Leave a Reply